দেশ পরিচিতি: মালি

মুসলিম ঐতিহ্যের দেশ মালি যেভাবে দরিদ্র রাষ্ট্রে পরিণত হলো

মালি, পশ্চিম আফ্রিকার স্থলবেষ্টিত একটি রাষ্ট্র। এটি আয়তনে আফ্রিকার অষ্টম বৃহত্তম দেশ এবং একই সাথে আফ্রিকার সবচেয়ে গরিবতম দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি। দেশটির আয়তন ১২,৪০,০০০ বর্গকিলোমিটার এবং জনসংখ্যা প্রায় ২১.৯ মিলিয়ন।

মুসলিম ঐতিহ্যের দেশ মালি

মালি মুসলিম ঐতিহ্যের দেশ। দেশটির ৯০ শতাংশ মানুষ মুসলমান। আফ্রিকায় ইসলামের প্রচারেও মালির গুরুত্ব অনেক। এর প্রতিটি শহরেই রয়েছে নান্দনিক মসজিদ। সব মসজিদেরই রয়েছে ঐতিহাসিক গৌরবময় অধ্যায়। যার মধ্যে মালির ডিজেনি শহরের বড় মসজিদ একটি। ইট আর মাটির তৈরি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মসজিদ এটি।

পশ্চিম আফ্রিকার এই গরিব দেশটির উত্তরে প্রায় অর্ধেক জুড়ে রয়েছে সাহারা মরুভূমি। দেশের বাকি অংশ জুড়ে রয়েছে সবুজ তৃণভূমি। জানা যায়, দেশটির অধিকাংশ মানুষ কৃষ্ণকায় আফ্রিকি, তাদের বাস গ্রামাঞ্চলে। কৃষিকাজ ও পশুপালনের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করেন তারা। এই দেশটির অর্ধেকেরও বেশি নাগরিক দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। তবে বর্তমানে এটি দরিদ্র দেশ হলেও একসময় এটি ছিল বেশ ধনী ও সচ্ছল দেশ। যখন সেখানে ইসলামী খেলাফত ব্যবস্থা ছিল, তখন এই অঞ্চলটি বিশ্বের অন্যতম ধনী অঞ্চল হিসেবে পরিচিত ছিলো।

মানসা মুসা, যিনি ছিলেন ইতিহাসের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি। বর্তমান বিশ্বে ধনী ব্যক্তিদের তালিকায় থাকা বিল গেটস, ওয়ারেন বাফেট অথবা ইলন মাস্কের মতো বহু ধনী লোকদের আমরা সবাই-ই চিনি। কিন্তু মানসা মুসা ছিলেন তাদের চেয়ে বহুগুণ ধনী। জানা যায়, যে সময় দেশটি ধনী ও স্বচ্ছল দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল, সে সময় মালির রাজা ছিলেন মানসা মুসা। তিনি ছিলেন মালির দশম রাজা। ইতিহাসে গত এক হাজার বছরের মধ্যে সবচেয়ে সম্পদশালী ব্যক্তি ছিলেন তিনি। কিন্তু এর পরবর্তীতে যতো ব্যক্তি ধনীদের তালিকায় নাম লিখিয়েছেন, তারা কেউই চৌদ্দ শতকের মালির মুসলিম শাসক মানসা মুসার চেয়ে বেশি ধন সম্পদের মালিক ছিলেন না কিংবা হতে পারেনি। যেখানে বিল গেটসের সম্পত্তির পরিমাণ মাত্র ১৩৮ বিলিয়ন ডলার! সেখানে মানসা মুসার তৎকালীন ধন-সম্পত্তি বর্তমান মুদ্রায় রূপান্তর করলে সেটার পরিমাণ হবে প্রায় ৪০০ বিলিয়ন ডলার।

মূলত, দশম রাজা মানসা মুসার কারণেই মালি একসময় পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা ধনী দেশে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য,  একসময়ের সর্বাপেক্ষা ধনী দেশটিই আজ পৃথিবীর সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলির অন্যতম একটি। অনেকের মতে, মালি রাষ্ট্রের স্বাধীনতাই তাদের দারিদ্রতার আসল কারণ। জানা যায়, ১৮৯৫ থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত ফরাসিদের অধিকারে ছিলো দেশটি। ১৯৬০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ফরাসি উপনিবেশের কবল থেকে স্বাধীনতা লাভ করে মালি প্রজাতন্ত্র। কিন্তু স্বাধীনতা লাভের পরও নানা চুক্তির আওতায় মোট জাতীয় সম্পদের ৮৫ ভাগ চলে যায় প্যারিসে। আর সম্পদের মাত্র ১৫ ভাগ থাকে মালির জনগণের জন্য। যার কারণে আজ মালির এই দুরবস্থা। তবে শুধু ভাগ বাটোয়ারাই নয়, মালির দারিদ্রের আরেকটি প্রধান কারণ হলো রাজার দানশীল মনমানসিকতা। মানসা মুসা একদিকে যেমন ধনী ছিলেন,তেমনি তার দানশীলতাও ছিল চোখে পড়ার মতো। তার সম্পদের যেমন অকুলান ছিলনা, তেমনি তিনি দান করতেও কৃপণতা করতেন না। কিন্তু কথায় আছে না, ‘সব ভালো ভাল নয়।’ তার এ দানশীলতার কারণে কেবল নিজ অঞ্চলই নয়, পুরো দেশের অর্থনীতিতে পর্যন্ত ধস নেমেছিল।

সর্বকালের সেরা ধনী মানসা মুসা

ইতিহাস থেকে জানা গেছে, একবার ৬০ হাজার মানুষের একটি দল নিয়ে মালি ত্যাগ করেন মুসা। তার সেই দলে ছিলেন সম্পূর্ণ মন্ত্রী পরিষদ, কর্মকর্তারা, সৈনিক, কবি, ব্যবসায়ী, উটচালক ও ১২ হাজার দাস-দাসী,শত শত উট আর বিপুল পরিমাণে খাঁটি স্বর্ণ। শুধু তাই নয়, দলের একজন দাসের গায়েও ছিলো স্বর্ণখচিত পারস্যের সিল্কের জামা। তাদের সাথে খাবারের জন্য ছিলো ছাগল ও ভেড়ার এক বিশাল বহর। বিশাল দলবল নিয়ে কায়রোতে তিন মাস অবস্থান করেন রাজা মানসা মুসা। কায়রোতে থাকাকালীন সময়ে তিনি সেখানকার মানুষকে যে পরিমাণ স্বর্ণ দান করেছেন,তাতে মানুষের উপকারের বদলে যেন ক্ষতিটাই বেশি হয়েছে। জানা যায়, এ তিন মাসে তিনি কায়রোর মানুষকে যে পরিমাণ স্বর্ণ দান করেছেন তাতে পরবর্তী ১০ বছর ওই পুরো অঞ্চলে স্বর্ণের দাম তলানিতে গিয়ে পৌঁছায়, সেখানকার অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়ে। তবে তার এই অতি দানশীলতাই তাকে বিশ্বের কাছে পরিচিতি এনে দেয়। এ ঘটনার পরই মালি আর নিজেকে বিশ্বের মানচিত্রে স্থান করে দেন তিনি।

তবে দশম রাজা মানসা মুসা যে বিপুল পরিমাণ ঐশ্বর্য পরবর্তী প্রজন্মের জন্য রেখে গিয়েছিলেন পরবর্তী প্রজন্মের শাসকরা কেউই সেগুলো রক্ষা করতে পারেন নি। সময়ের সাথে সাথে আজ সেই সমৃদ্ধিশালী দেশ মুসলমানদের হাতছাড়া হয়ে গেছে। আর নাম লিখিয়েছে বিশ্বের গরিবতম দেশগুলোর তালিকায়। তবে দরিদ্র হলেও মালি বিশ্বে যে ইতিহাস তৈরি করেছে, তা হারিয়ে যায়নি। পশ্চিম আফ্রিকার মুসলিমদের জীবনে এই ইতিহাস এখনো জীবন্ত।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url