কিভাবে কাজ করে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ?

বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী এবং বৃহত্তম টেলিস্কোপ হলো জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ। মহাবিশ্বকে আরও বেশি সুস্পষ্টভাবে দেখতেই বানানো হয়েছে এটি। অন্যান্য টেলিস্কোপের মতো এর প্রথম এবং প্রধান কাজ হলো পর্যবেক্ষণ করা। তারপর প্রাপ্ত তথ্যের প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে ছবি তৈরি করা। হাবল টেলিস্কোপের থেকে প্রায় ১০০ গুণ শক্তিশালী এটি। হাবল যেখানে ছায়াপথ সৃষ্টির শুরুর দিকের তথ্য দিতে ব্যর্থ, সেখানে জেমস ওয়েব বিগব্যাং বা মহাবিস্ম্ফোরণের পর থেকে ঘটা প্রতিটি মুহূর্তের তথ্য দেবে।

জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ

এ টেলিস্কোপের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে দুটি। একটি হলো ছায়াপথের জন্ম ও বিবর্তন এবং নক্ষত্র ও গ্রহের সৃষ্টি কীভাবে হলো, তা খুঁজে বের করতে সহযোগিতা করা। দ্বিতীয়টি হলো দূরবর্তী গ্রহের বায়ুমণ্ডল পর্যবেক্ষণ করা। ফলে অন্য গ্রহে প্রাণের সন্ধান এবং সেই গ্রহ মানব বসবাসের উপযোগী কি না, তা জানা যাবে।


অনেক বড় ওয়েব লেনকে কভার করার ক্ষমতা থাকায় এ টেলিস্কোপটি মহাকাশে অতীত পর্যন্ত দেখতে পারবে। যে সমস্ত গ্যালাক্সিগুলো ও নক্ষত্রগুলো অনেক অনেক বছর আগে তৈরি হয়েছিল, আর যাদের আলো এখনো আমাদের পৃথিবীতে আসছে সবই দেখা সম্ভব হবে এর মাধ্যমে।  যার কারণে অনেক বিজ্ঞানী এটাকে টাইম মেশিনের সাথে তুলনা করছেন। এই টেলিস্কোপ ঘিরে অনেক বৈজ্ঞানিক গবেষণা হচ্ছে।


টেলিস্কোপ থেকে প্রাপ্ত তথ্যগুলো বাইনারি বিন্যাসে জমা হয়। সেই বিন্যাসের আলোকেই তৈরি হয় মহাবিশ্বের রহস্যের ছবি। এতে ১৮টি আলোর প্রতিফলন করতে সক্ষম বিশালাকার আয়না আছে। ৬.৫ মিটার চওড়া এ আয়না সোনার পাত দিয়ে মোড়ানো। সোনার পাত বসানোর মূল কারণ হলো, একমাত্র স্বর্ণই সবচেয়ে বেশি ইনফ্রারেড রে প্রতিফলন করতে পারে। ইনফ্রারেড আলো সহজেই এই ধরনের মহাজাগতিক ধূলিকণা এবং গ্যাস ভেদ করতে পারে।  ফলে এটি ধুলা এবং গ্যাস দ্বারা আবৃত থাকা নক্ষত্রের বায়ুমন্ডল দেখতেও সাহায্য করছে। ওই আয়নাতে সৃষ্টির শুরুর দিককার নক্ষত্রগুলোর আলো প্রতিফলিত হচ্ছে।


দূরবর্তী আকাশের ছবি তোলার জন্য টেলিস্কোপটিতে রয়েছে নিয়ার-ইনফ্রারেড ক্যামেরা, নিয়ার-ইনফ্রারেড স্পেক্টোগ্রাফ, মিড-ইনফ্রারেড ইনস্ট্রুমেন্ট এবং নিয়ার ইনফ্রারেড ইমেজার ও স্লিটলেস স্পেক্ট্রোগ্রাফ। প্ল্যানেটারি সিস্টেম বা গ্রহ ব্যবস্থা সম্পর্কে মহাকাশচারীদের জানতে সাহায্য করছে টেলিস্কোপটির নিয়ার ইনফ্রারেড ইমেজার ও স্লিটলেস স্পেক্ট্রোগ্রাফ। এই বিশেষ যন্ত্র ০.৬ থেকে ৫ মাইক্রন পর্যন্ত আলো ক্যাপচার করতে পারে। 


পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে জটিল ইঞ্জিনিয়ারিংগুলোর একটি হলো এই জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ। এটি নির্মাণ করেছে যৌথভাবে নাসা, ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা ও কানাডিয়ান স্পেস এজেন্সি। জটিল সব যন্ত্রাংশে নির্মিত এ টেলিস্কোপটির নির্মাণ ব্যয় ১০ হাজার কোটি ডলার। আর নির্মাণে সময় লেগেছে প্রায় ২৫ বছরের মতো। এ নতুন প্রজন্মের টেলিস্কোপ নির্মাণে কাজ করেছেন প্রায় ১০ হাজার মানুষ। এদের মধ্যে আছেন বিজ্ঞানী, কলাকুশলীসহ সংশ্লিষ্ট সবাই।


ষ্টির শুরুর দিককার নক্ষত্রগুলোর আলো প্রতিফলিত করছে জেমস্ ওয়েব টেলিস্কোপ

আকারের বড় হওয়ায় একে ভাঁজ করে রকেটে পুরে পাঠানো হয়েছিল। তিন শতাধিক সূক্ষ্ণ যন্ত্রকে কাজ করতে হয়েছে ভাঁজ খুলে একে কাজের উপযোগী করতে। টেলিস্কোপটি পৃথিবী থেকে ১৫ লাখ কিলোমিটার দূরে মহাকাশে অবস্থিত। এখন পর্যন্ত এত দূর কোনো নভোচারী যেতে পারেননি। উৎক্ষেপণের ২৯ দিন পর এটি মহাকাশে কার্যক্রম শুরু করে। ইতোমধ্যেই বেশ কয়েকটি ছবি তুলে সারা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ। 


এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ছিলো সম্প্রতি নাসার প্রকাশিত মহাশূন্যের ১৩৫০ কোটি বছর আগের রঙ্গিন ছবিটি। বহির্বিশ্বের এখন পর্যন্ত যত ছবি তোলা হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে ধারালো এবং গভীরতম ইনফ্রারেড ছবি এটি। এ ছবিতে তারকামন্ডলী ও ছায়াপথের যে আলোকরশ্মির বিচ্ছুরণ দেখা যাচ্ছে, তা শত শত কোটি বছর পাড়ি দিয়ে আমাদের কাছে এসে পৌঁছেছে। 


সাধারণত কোনো বস্তুর আলো যখন আমাদের চোখে এসে পড়ে আমরা তখন সেই বস্তুটিকে দেখতে পাই। জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ মহাকাশের যে অংশের ছবি পাঠিয়েছে সেখান থেকে পৃথিবীতে আলো আসতে সময় লাগে প্রায় চারশ ৬০ কোটি বছর। ফলে টেলিস্কোপের ছবিটি আসলে চারশ ৬০ কোটি বছর আগের চেহারা দেখাচ্ছে। আশা করা হচ্ছে, জেমস ওয়েবের মাধ্যমেই মহাকাশ রহস্যের অনেকটা জট খুলতে সক্ষম হবেন বিজ্ঞানীরা।


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url