উড়ে আসা অতিথি পাখিরা যেন ফিরে যায় হাসিমুখে।

শীত এলেই প্রতি বছর দূর-দূরান্ত থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে হাজির হয় অতিথি পাখিরা। এরা আসে মূলত উত্তর মেরু, ইউরোপ ও হিমালয় পর্বতমালার আশেপাশের এলাকা থেকে , বিশেষ করে শীতপ্রধান দেশ সাইবেরিয়া, আসাম, ফিলিপিন্স, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া, ফিনল্যান্ড, এন্টার্কটিকা, চীনের লাদাখ অঞ্চল থেকে।কারণ এ সময় দেশগুলোতে তাপমাত্রা মাইনাস শূন্য ডিগ্রিতে নেমে আসে। ফলে প্রচন্ড তুষারপাতে জীবন ধারণ অসম্ভব হয়ে উঠে।


শীত এলেই প্রতি বছর দূর-দূরান্ত থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে হাজির হয় অতিথি পাখিরা।

গাছের পাতা ঝরে যায় শীতে। এমনকি পাখির দেহ হতে পালক পর্যন্ত খসে পড়ে। আর সেই সাথে তীব্র খাদ্যসংকট তো আছেই। তুষারপাত ও খাদ্যসংকটের কারণে পাখিদের জীবন প্রায় বিপন্ন হয়ে পড়ে। তখন তারা পাড়ি জমায় কম শীতের দেশে। প্রচণ্ড শীতের হাত থেকে বাঁচতেই মূলত পাখিদের এ যাত্রা।


ডিসেম্বর-জানুয়ারি এই দুই মাসে সবচেয়ে বেশি পাখি আসে বাংলাদেশে। সৃষ্টিগতভাবে এসব পাখিদের শারীরিক গঠন খুব মজবুত। তাই ৬০০ থেকে ১৩০০ মিটার উঁচু আকাশসীমা দিয়ে উড়ে আসতে পারে অনায়াসেই। বড় পাখিরা ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার আর ছোট পাখিরা ঘণ্টায় ৩০ কিলোমিটার বেগে উড়তে পারে। দিনে-রাতে এরা প্রায় ২৫০ কিলোমটার পঘ উড়ার ক্ষমতা রাখে।


কিছু পাখি বছরে প্রায় ২২ হাজার মাইল পথ অনায়াসে পাড়ি দিয়ে চলে আসে বাংলাদেশে। এমন এক জাতীয় অতিথি পাখির নাম সামুদ্রিক শঙ্খচিল। আমাদের দেশে মোট পাখি আছে প্রায় ৬২৮ প্রজাতির। এর মধ্যে ২৪৪ প্রজাতিই স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে বাস করে না। শীত আসার সঙ্গে সঙ্গে এরা আমাদের দেশে আসতে শুরু করে।


অতিথি পাখি

নাতিশীতোষ্ণ দেশ হিসেবে বাংলাদেশ তখন হয়ে ওঠে অতিথি পাখির খাদ্য ও জীবনধারণের নিরাপদ আবাসস্থল। এরইমধ্যে আমাদের নদ-নদী, হাওড়-বাঁওড়, বিল-ঝিল, চরাঞ্চল, পুকুর, ডোবা-জলাশয়ে, পরিযায়ী পাখিরা আসতে শুরু করেছে।


দেশের যেসব এলাকায় এসব পাখি আসে তার মধ্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অন্যতম। ক্যাম্পাসের নানা রকমের গাছপালা ও খাদ্যে ভরপুর লেকগুলো হয়ে উঠে তাদের বিচরণস্থল।ভৌগোলিক পরিবেশ উপযুক্ত হওয়ায় প্রতিবছরই প্রচুর পাখির দেখা মেলে। ছোট-বড় মিলিয়ে এখানে প্রায় ১৭টি লেকের মধ্যে ২০-২৫ প্রজাতির অতিথি পাখি আসে।


এছাড়া বাংলাদেশের নীলফামারীর নীলসাগর, নিঝুম দ্বীপ, হাকালুকি হাওর, মিরপুর চিড়িয়াখানার লেক, বরিশালের দুর্গাসাগর, সিরাজগঞ্জের হুরা, টাঙ্গুয়ার হাওর, হাটল হাওর এবং সোনাদিয়া অঞ্চলেও দেখা যায় এদের।নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় অপেক্ষাকৃত কম শীতের দেশে ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে আসে তারা। অতিথি পাখিগুলো তাদের নামের মতোই সুন্দর। বাহারি রংয়ের এসব পাখি দেখলে নিমিষেই মন ভালো হয়ে যায় সবার।


উড়ে আসা অতিথি পাখি যেন ফিরে যায় হাসিমুখে

অনেক পাখি বাংলাদেশে পুরো শীতকাল কাটিয়ে দেয়। শীতের রেশ কেটে গেলেই বসন্তের সময়টাতে এসব পরিযায়ী পাখি আবারও তাদের চিরচেনা ভূমিতে ফিরে যায়। এক্ষেত্রে পথ চিনতে তাদের কোন ভুল হয় না। এছাড়া তারা রাতের বেলায় তারকা ও দিনের বেলায় সূর্যের অবস্থান দেখেও দিক নির্ণয় করে।


স্বল্প-বিরতিতে আসা এ পাখিগুলো এখানে এসে যে শুধু নিজেরাই উপকৃত হয় তা নয়, অতিথি পাখির কারণে আমরাও উপকৃত হই। প্রকৃতির শোভাবর্ধনের পাশাপাশি এসব পাখি ক্ষতিকর পোকামাকড় খেয়ে কৃষকের উপকার করে। ফলে এর সঙ্গে ফসল উৎপাদন বাড়ার বিষয়টি জড়িত।অন্যদিকে অতিথি পাখির কারণে শীতে অভ্যন্তরীণ পর্যটন বাড়ে। জলাশয়গুলোতে অতিথি পাখির অনাবিল সৌন্দর্য দেখতে পাখিপ্রেমীরা ভিড় করে। যা দেশীয় পর্যটন শিল্পের জন্য ইতিবাচক।


কিন্তু দুঃখজনক হলো নিরাপত্তার জন্য এদেশে এলেও শিকারিদের ফাঁদে পড়ে প্রতি বছরই প্রাণ হারায় অনেক অতিথি পাখি। যেখানে অতিথি পাখিদের হাসি–খুশিতে দিন পার করার কথা, সেখানে তারা নিজের জীবন নিয়ে স্বদেশে ফেরার শঙ্কায় থাকে। এছাড়া বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যয় তো আছেই।


এতে করে একদিকে যেমন অতিথি পাখির সংখ্যা কমে যাচ্ছে, অন্যদিকে প্রকৃতিও তার সৌন্দর্য হারাচ্ছে। তাই প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় আমাদের সবার উচিত স্বল্প সময়ের এ অতিথিদের রক্ষা করা। উড়ে আসা এসব অতিথি পাখি যেন হাসিমুখে ফিরে যায়, সে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। আর এর জন্য সরকারি কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় রুখে দিতে হবে অবৈধ শিকারিদের।

Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url